আগুন যেন বিদ্যুৎ গ্রিডের পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় জাতীয় গ্রিডের ঈশ্বরদী উপকেন্দ্রের একটি ফিডারে আগুন লেগে বুধবার রাতে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে ১৭ জেলা। চলতি বছর গ্রিডে ছয় নম্বর অগ্নিকাণ্ড এটি। সর্বশেষ সিলেটের কুমারগাও গ্রিডে আগুন লাগে, প্রায় দুই দিন বিদ্যুৎবিহীন থাকে পুরো অঞ্চল। সেখানেও করা হয় তদন্ত কমিটি। এর আগের ঘটনাগুলোতেও কমিটি হয়েছিল। একের পর এক আগুন লাগার ঘটনায় বিদ্যুৎ বিভাগ থেকেও করা হয়েছে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। কিন্তু বন্ধ হয়নি গ্রিড বিপর্যয়।
এই পরিস্থিতি আসলে কীসের ইঙ্গিত দেয় এমন প্রশ্ন করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন হয়, সুপারিশও হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখে না। এ কারণেই এত বার গ্রিডে আগুন লাগে।
ঈশ্বরদীতে অগ্নিকাণ্ডে খুলনা, ঢাকা ও বরিশাল অঞ্চলের ১৭টি জেলা মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে ২ ডিসেম্বর রাতে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পরদিন সকাল হয়। এরপর বরাবরের মতো গঠন করা হয়েছে একটি তদন্ত কমিটি। কমিটি গঠন করাই যেন গ্রিডে আগুন লাগার একমাত্র সমাধান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটি (ঈশ্বরদী) ৩৮ বছরের পুরনো উপকেন্দ্র। সিলেটেরটাও পুরনো ছিল। আমরা ধীরে ধীরে এই ধরনের পুরনো কেন্দ্রগুলো সংস্কার শুরু করেছি। বেশ কিছু পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে তিনি জানান, ঈশ্বরদীর উপকেন্দ্রটির ১৩২ কেভি ব্রেকারে যে গ্যাস থাকে, সেটা কোনওভাবে বের হয়ে গিয়েছিল। তাতে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে মেরামত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
এদিকে খুলনা বিদ্যুৎ বিভাগের আঞ্চলিক লোড ডেসপাস সেন্টার সূত্র জানায়, এ ঘটনার কারণে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা, বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, পিরোজপুর, রাজবাড়ীর পাংশা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ৫২ মিনিটে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরে বিকল্প লাইনে খুলনা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় রাত ১২টা ৩ মিনিটে। তবে এই গ্রিডের অধীন সব এলাকায় বিদ্যুৎ আসতে আসতে সকাল হয়ে যায় বলে সূত্র জানায়।
পিজিসিবি জানায়, বগুড়ার গ্রিড সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মুকসেদুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। তাদের তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, আর পিজিসিবি বলছে এগুলো পুরনো। এসব সেনসিটিভ উপকেন্দ্রগুলোতে এত পুরনো মানহীন যন্ত্রাংশ ব্যবহার দুঃখজনক। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে আর সরবরাহের এত মানহীন যন্ত্রাংশের ব্যবহার মানা যায় না। এটি অবশ্যই অবহেলা। যন্ত্রাংশ বদলানো রুটিন ওয়ার্ক হওয়া উচিত। প্রকল্পের দোহাই দিয়ে বসে থাকা যাবে না।
এর আগে গত ১৬ নভেম্বর সিলেট কুমারগাঁও উপকেন্দ্রে আগুন লাগে। আগুনে পিজিসিবি এবং পিডিবির দুটি ট্রান্সফরমার পুড়ে যায়। একইসঙ্গে সুইচ রুম, সার্কিট ব্রেকারও পুড়ে যায়। এতে সিলেট ৩১ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। সিলেটে গ্রিডে অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, উপকেন্দ্রে কোনও সিসি ক্যামেরাই নেই।
চলতি বছর আরও তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুর একটার দিকে ময়মনসিংহ মহানগরীর কেওয়াটখালীতে আগুনে পাওয়ার গ্রিডের ট্রান্সফরমার পুড়ে যায়। এতে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার আগেই ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে একই কেন্দ্রে ফের আগুন লাগে। এতে ময়মনসিংহবাসী প্রায় তিন দিন চরম ভোগান্তিতে ছিল।
গত ২০ মে ভেড়ামারা পিজিসিবি’র সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যদিও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ওই বিপর্যয় ঘটে বলে জানায় পিজিসিবি। সে সময় প্রায় দুই থেকে তিন দিন ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ ছিল না।
গত ১১ এপ্রিল বিকালে হঠাৎ করেই রাজধানীর রামপুরার উলন গ্রিডে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে রাজধানীর একাংশ কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। সাবস্টেশনটি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) হলেও এটি ডিপিডিসি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ওটা পরিচালনা করছে পিজিসিবি। ডিপিডিসি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ চলছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, গ্রিডের যন্ত্রাংশ পুরনো হলে অনেক আগেই সেগুলো বদলানোর দরকার ছিল। একের পর এক আগুন লাগছে আর তারা তদন্ত কমিটি করেই দায় সারছেন। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা।