সামরিক কর্তৃত্বের জোরে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জিয়া। নির্বাচন করতে না পারার দুঃখ নিয়ে জিয়াউর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি জিয়াউর রহমানকে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন।
কিন্তু, জিয়া নিজেই যে ক্ষমতাসীন হয়ে নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে অংশ গ্রহন করবেন, তা চিন্তাই করতে পারেন নি সায়েম।
অন্যদিকে ক্ষমতা হস্তান্তরে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দিলে জিয়া সামরিক আইনের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহনের প্রস্তাব করেন।
এর আগে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সায়েম কার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তা নিয়ে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়।
ইংরেজিতে লেখা অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’ (বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি) নামে স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থে এ নিয়ে সায়েম লিখেছেন, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তে আমি জিয়াকে বলি, আমি যেহেতু নির্বাচন করে যেতে পারলাম না, আমি তাঁকে অনুরোধ করব যেন তিনি নির্বাচন দেন।
তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন যে, তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। শুনে আমি খুশি হই। কিন্তু, আমি তখন ভাবতে পারিনি যে, নির্বাচনে তিনি নিজেই অংশ নেবেন। সেরকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবেও, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে নিজে অংশ গ্রহন করবেন এমন চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি।
এর পরে সায়েম আরো যোগ করেন, বস্তুত জিয়া তাঁর অবস্থান সংহত করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে একটা গণভোট করে ফেলেন। তাঁর প্রতি এবং তাঁর ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি ভোটারদের আস্থা আছে কিনা এই ছিল গণভোটের বিষয়। কিন্তু, সেই গণভোটে হ্যাঁ বাক্সে এত বেশি ভোট পড়ে যে জনগণ সেই ফলাফলকে হাস্যকর ভাবে অবিশ্বাস্য মনে করে।
বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের পর জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি বঙ্গভবন ত্যাগ করেন।
এর আগে তিনি সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহনে সম্মত হয়েছিলেন দেশ শাসনের জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তরের আশায়।
কিন্তু কোন পরিস্থিতি তাকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না করেই বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হয়েছিল সেইসব কথা তিনি এ বইতে বলেছেন।
রাষ্ট্রপতি সায়েমের বিশেষ সহযোগী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে উপদেষ্টা কাউন্সিলের কতিপয় সিনিয়র বেসামরিক সদস্য ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার অনুরোধ করেন।
তারা জানান, তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে তারা কাজ করতে চান।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় ক্ষমতাসীন থেকেও সেদিন বেসামরিক ব্যক্তিগণ সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করতে চেয়েছিলেন।
এছাড়াও এতে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে মনে করে সায়েম তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করতে সম্মত হন।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগে সম্মত হলেও তিনি কার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তা নিয়ে সাংবিধানিক সমস্যা ছিল। কারণ, এর আগে ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে সংসদসহ সরকারের অন্যান্য পদের সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদটিও বাতিল করেছিলেন।
পরে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর অপর আদেশে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে। সুতরাং তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কিভাবে, এরকম একটি সাংবিধানিক সমস্যা তখন ছিল।
আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম লিখেছেন, এরকম দুর্দশায় পড়ে আমি ভাবছিলাম, কোনরূপ সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি না করে আমি কিভাবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে আসতে পারি। কারণ, আমি আমার পদত্যাগপত্র যাকে সম্মোধন করে লিখব, সেরকম কেউ ছিল না।
এ অবস্থায় বিচারপতি সায়েম তার বিশেষ সহযোগীর মাধ্যমে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানদের ডেকে পাঠান। তাদের ডেকে পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ সহযোগীকে খুবই আগ্রহী মনে হয়েছিল।
এর আগে এই বিশেষ সহযোগী বিচারপতি আবদুস সাত্তার সর্ম্পকে এক মন্তব্যে বলেছিলেন সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকার সময় সলাপরামর্শের জন্য রাজনীতিবিদেরা সেনা নিবাসে যেতেন।
বঙ্গভবনে থাকতেই তিনি সেকথা জানতে পারেন। তবে, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কোন নেতা ছিলেন না। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আরও জানতে পারেন তার বিশেষ সহযোগী যার সঙ্গে তিনি রোজ বিকালে হাঁটতে যেতেন তিনিও সেনানিবাসে যাতায়াত করতেন।
পরবর্তী সময়ে তার এই বিশেষ সহযোগী আবদুস সাত্তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এই যোগাযোগের কারণে পুরস্কার হিসাবে সাত্তার নিয়োগ পেয়েছিলেন কিনা তা কিন্তু সায়েম উল্লেখ করেন নি।
এদিকে, বাহিনী প্রধানদের আসার পর সায়েম তাঁর পদত্যাগের ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চান। কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল এই পদত্যাগের ফলে সশস্ত্রবাহিনীগুলোর ভিতরে মতভেদ দেখা দিতে পারে।
তাদের মতামত এবং ও সম্মতি পাওয়ার পর সায়েম তাঁর বিশেষ সহযোগীর মাধ্যমে জিয়াকে আসতে বলেন। জিয়া আসার পর তিনি প্রসঙ্গটি তোলেন।
একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি এবং সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতার অভাব সায়েমের পদত্যাগের পথে যে বাধা ছিল তা রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহযোগী (আবদুস সাত্তার) উপলব্দি করেন।
তিনি উঠে আইন সচিবের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য তার দরজার দিকে এগিয়ে গেলে তাকে থামিয়ে দেন জিয়া। তিনি (জিয়া) তাকে তার আসনে বসে থাকতেই বলেন।
জিয়া প্রেসিডেন্ট সায়েমকে বলেন, তিনি ইতোমধ্যেই যখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে গেছেন, তখন এরকম সঙ্কট তিনি সামরিক আইনের কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবেলা করবেন।
পদত্যাগের বিষয়ে সায়েম লিখেছেন, যেভাবে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে আমাকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, সেজন্য এবং জিয়ার পক্ষে ওকালতির জন্যও আমার মানসিক চাপ বোধ হয়েছে, ক্ষোভ হয়েছে।
পরিস্থিতির এই জটিলতা বেশ ভালোভাবেই এড়ানো সম্ভব ছিল বা অন্তত হ্রাস করা যেত, উপদেষ্টা কাউন্সিলের ভিতরে ও বাইরে জিয়ার অনুসারীরা যারা ইতোমধ্যে জিয়ার বশীভূত হয়ে গেছেন, তারা যদি একটু বিবেচক এবং কৌশলী হতেন।
সায়েমের দৃষ্টিতে সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক সরকারের দায়িত্ব গ্রহন সেনাপ্রধানের স্বার্থের অনুকূলে একটি পদক্ষেপ হিসাবে। সামরিক শাসন মানে, তাঁর মতে সেনাপ্রধানের শাসন।
এর ফলে দেশের মানুষ নিজেদের শাসনকর্তা নির্বাচন করার ক্ষমতা হারায় এবং রাজনীতিবিদেরা দেশ শাসনের স্বাভাবিক অধিকার হারান। সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহন, তার মতে কখনো কখনো রক্তপাতহীন হলেও, কখনোই অহিংস হয় না।
আরও পড়ুন: গর্বাচেভের মৃত্যুতে সমবেদনা প্রকাশ পুতিনের