২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

ঘটমান সংবাদ এ স্বাগতম।  সাথেই থাকুন।
হোমরাজনীতিঅন্যান্য রাজনীতিআল্লামা শফীর মৃত্যুর পেছনে ‘উগ্রপন্থীরা’, থমকে আছে বেফাকের তদন্ত

আল্লামা শফীর মৃত্যুর পেছনে ‘উগ্রপন্থীরা’, থমকে আছে বেফাকের তদন্ত

চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় এ বছরের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ঘটেছিল ছাত্র-বিক্ষোভ। এর সুযোগ নিয়ে ‘উগ্রপন্থী’ কিছু ছাত্রের নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীকে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে নতুন একটি গ্রন্থে। এতে রয়েছে তাঁর জীবনের শেষ তিন দিনের সঙ্গী নাতি মাওলানা আরশাদ ও খাদিম মাওলানা হোজাইফা আহমদের জবানবন্দি। হাটহাজারীতে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও নিজেদের সাবেক সভাপতির চিকিৎসা বিলম্বের ঘটনায় বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) গঠিত তদন্ত কমিটি আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরু করেনি।

নতুন গ্রন্থটির নাম ‘শহীদ শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.): হাটহাজারীতে জীবনের শেষ তিন দিন’। এতে আরও দাবি করা হয়েছে, শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হলেও সময়মতো চিকিৎসাবঞ্চিত হয়েছেন আহমদ শফী। ৩৬ পৃষ্ঠার বইটিতে তাঁর নাতি ও খাদেমের ভাষ্যে উঠে এসেছে— কয়েকটি কক্ষ, এসি ও টেবিল ভাঙচুরের পাশাপাশি ‘উগ্রপন্থীরা’ মাদ্রাসাটির শিক্ষকদের নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার লুটপাট করেছে।

বইটির তথ্যের ব্যাপারে অনুসন্ধান করেছে বাংলা ট্রিবিউন। এতে ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত দুই অভিযুক্তের একজন ২০১৩ সালে বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার আসামি মুফতি হারুন ইজহারের অনুসারী হিসেবে পরিচয় পাওয়া গেছে। অন্যজন হাটহাজারীর স্থানীয় এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

আহমদ শফীর নাতি ও খাদেমের দাবি, আরও কয়েকজন ‘উগ্রপন্থী’ ১৬ সেপ্টেম্বর ছাত্র-বিক্ষোভের আগে-পরে লালখান বাজার মাদ্রাসায় মুফতি হারুন ইজহারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং ঘটনার পরেও তাদের দেখা হয়েছে।

বইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আহমদ শফীর সন্তান মাওলানা ইউসূফের ছেলে আরশাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি যা বলেছি, সব বইতে আছে। হাসানুজ্জামান ও শহিদুল্লাহকে মুখ দেখে চিনি, ওরা হাটহাজারীতে পড়ে। আমি যা বলেছি, বাস্তবেও তাই হয়েছে।’

একই প্রসঙ্গে প্রয়াত আহমদ শফীর খাদেম হোজাইফা আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিছু কথা জাতি না জানলেই নয়— গ্রন্থে এই পর্বটি আমার ভাষ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে।’

আহমদ শফীর কক্ষে ‘উগ্রপন্থী’ হাসানুজ্জামান ও শহিদুল্লাহ

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে ‍মৃত্যুর আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় অবস্থা করেছেন আহমদ শফী। তাঁর জীবনের শেষ দুই দিন নাতি আরশাদ ও খাদেম (সেবক) হোজাইফা আহমদ সঙ্গেই ছিলেন।

নতুন গ্রন্থের প্রথম পর্বে নাতি উল্লেখ করেন, ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে আহমদ শফী দাওরায়ে হাদিসের ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হট্টগোল শুরু হয়। তখনই আরশাদ খবর পান, তার চাচা আনাস মাদানী ও প্রতিষ্ঠানের মুঈনে মুহতামিম শেখ আহমদের কক্ষ ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। এরপর শেখ আহমদকে সঙ্গে নিয়ে আহমদ শফীর কক্ষে আসে পাঁচজনের একটি দল, এর নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা হাসানুজ্জামান।

আবনায়ে দারুল উলুম হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত বইটিতে হাসানুজ্জামানকে ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে দাবি করেছেন আরশাদ। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘আল্লামা শেখ আহমদ সাহেবের সঙ্গে উগ্রপন্থী নেতা হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি দল মুহতামিম (আহমদ শফী) সাহেবের কক্ষে আসে। এরপরই তারা হযরতকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে।’

আরশাদের তথ্যানুযায়ী, তিনি (আল্লামা শফী) বারবার বলছিলেন, ‘অভিযোগ লিখিত আকারে উপস্থাপন করো, আমি দস্তখত করবো। কিন্তু বাবারা তোমরা এইভাবে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার কোরো না।’

হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন দলটি চলে যাওয়ার পরপরই মাওলানা শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের আরেকটি দল আসে।

হাসানুজ্জামান ও শহিদুল্লাহকে ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন হোজাইফা আহমদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শহিদুল্লাহ স্থানীয়। আমি আরও কয়েকজনের নাম জানি। চারিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা তৈয়্যবের ছেলে তাওহিদ আছে। মাওলানা নোমান ফয়জীর (হেফাজতের নতুন কমিটির উপদেষ্টা) খাদেম ছিলেন হাসানুজ্জামান। আমাদের সঙ্গে দাওরা পড়েছে গত বছর। আরেকজনের নাম নাসির, হাটহাজারীর পাশেই তার বাড়ি। আরেকজন আছে আবু সায়ীদ, সে হুজুরের সঙ্গে বেশি বেয়াদবি করেছে। এখন দাওরায়ে হাদিস পড়ছে। সেদিন হুজুরের গায়ে হাত তোলা কেবল বাকি রেখেছিল তারা।’

হোজাইফা আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান— হাসানুজ্জামান, শহিদুল্লাহ, আবু সায়ীদ, নাসিররা মেখল মাদ্রাসা থেকে পড়ে এসেছে। তার দাবি, ‘দুই-তিন বছর আগে হাটহাজারীতে এসে ভর্তি হয়েছে তারা। সিলেটেরও কয়েকজন ছাত্র আছে। সবাই ঘটনার কয়েকদিন পর হারুন ইজহারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল এবং এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল।’

এ প্রসঙ্গে জানার জন্য হাসানুজ্জামান ও আবু সায়ীদের মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনের পর থেকে নিজেদের ফেসবুক আইডি ও মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন তারা।

হাটহাজারী মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকার একাধিক স্থানীয় আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, হাসানুজ্জামান হাটহাজারী মাদ্রাসায় উলুমুল হাদিস বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। যদিও হাদিস বিভাগের দায়িত্বশীল মুফতি জসিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো চিনতে পারছি না। আমি দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস নিয়ে থাকি।’

হাটহাজারী মাদ্রাসার একাধিক ছাত্র ও আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মুফতি হারুন ইজহারের অনুসারী হিসেবে মাওলানা হাসানুজ্জামান পরিচিত এবং লালখান বাজার মাদ্রাসায় তার যাওয়া-আসা রয়েছে।

হাটহাজারী মাদ্রাসার এক সদ্য সাবেক আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসানুজ্জামান উলুমুল হাদিস (উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ) বিভাগে পড়াশোনা করে। নাসির মেশকাতে পড়াশোনা করে, হারুন ইজহারের কাছে তাদের যাওয়া-আসা রয়েছে। মূল আন্দোলনের সময় যেসব দাবি-দাওয়া সংবলিত লিফলেট দেখা গেছে, সেগুলো হারুন ইজহারের ওখান থেকে তৈরি করা।’

হাটহাজারী মাদ্রাসার মেশকাত জামাতের ছাত্র নাসির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তখন হাজার হাজার ছাত্রের বিক্ষোভ ছিল। এমন বিক্ষোভে একটু ইয়ে (বিশৃঙ্খলা বুঝিয়েছেন) তো হয়, জানেন। তবে হুজুরের সঙ্গে কোনও বেয়াদবি কিংবা তার চিকিৎসা বিলম্বের মতো কিছু ঘটেনি। যখন ‍হুজুরকে মাদ্রাসার দোতলা থেকে (বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য) নামানো হচ্ছিল, তখন ছাত্ররা নিজেদের অভিভাবকহীন ভেবেছে। হুজুর চলে গেলে কে অভিভাবক থাকবেন। মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক শেখ আহমদ সাহেব হুজুর আমাদের হুজুরের রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা কিছু বলিনি, আমাদের তো সেই ক্ষমতা ছিল না। হুজুরের মাধ্যমে আমাদের দাবি তুলে ধরেছি।’

নাসিরের দাবি— হাসানুজ্জামান, শহিদুল্লাহসহ বাকিদের তিনি চেনেন না। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মাওলানা উমর সাহেবের কক্ষ থেকে নেওয়া ছয় ভরি স্বর্ণ তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছেন। এছাড়া লালখান বাজার মাদ্রাসায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর শপথ অনুষ্ঠানের বিষয়ে তার কিছু জানা নেই।

আহমদ শফীর নাতি আরশাদ ও খাদেম হোজাইফার গ্রন্থে উল্লেখিত শহিদুল্লাহর সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তিনি জানান, তার বাড়ি হাটহাজারীতেই। ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বরের আন্দোলনের বিষয়ে শহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমি হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র, তাখাসসুসে পড়ি। বাসা থেকে আসা-যাওয়া করে পড়াশোনা করি। আন্দোলনে হাজার-হাজার শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে।’

গত ১২ অক্টোবর আল্লামা আহমদ শফীর কবর জিয়ারত করতে গেলে তাঁর খাদেম মাওলানা হোজাইফা আহমদকে ‘উগ্রপন্থী’ কয়েকজন ছাত্র সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আটকে রেখে মারধর করে বলে দাবি করেন এই খাদেম।

হেফাজতের বিগত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও শফীপন্থী হেফাজতের নেতা মুফতি মঈনুদ্দিন রুহিকে ব্যাপক মারধর করে বিক্ষোভকারীরা। তাদের নেতৃত্বে ‘উগ্রপন্থীরা’ই আছে বলে মনে করেন কওমি মাদ্রাসার কয়েকজন আলেম।

মঈনুদ্দিন রুহিকে মারধরের বিষয়টিকে বিক্ষোভ হিসেবে দেখছেন নাসির! তার মন্তব্য, ‘এটা তো ছাত্রদের বিক্ষোভের ঘটনা।’

এ প্রসঙ্গে মঈনুদ্দিন রুহি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ওপর হামলার ঘটনায় হাটহাজারী থানায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি মামলা করেছি। এতে জাকারিয়া নোমান, মাদ্রাসার ছাত্র শহিদুল্লাহসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। আমি তো মারধরের কারণে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম। তারা যেসব আচরণ করেছে তা তো আপনারা দেখেছেন। আমি থানায় বারবার যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোনও অগ্রগতি নেই। আগে ওসি ছিলেন যিনি, তাকেও বলেছি।’

হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম গত রবিবার (২৯ নভেম্বর) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখনও কিছু জানি না।’

বাংলা ট্রিবিউনের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি হুমায়ূন মাসুদ জানিয়েছেন, ওসি রফিকুল ইসলাম অন্তত তিন সপ্তাহ হয়েছে থানায় যোগ দিয়েছেন।

হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার অভ্যন্তরে বছর দুয়েক ধরেই ‘মানহাজি’ নামে জিহাদের অনুসারী একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে

কওমি মাদ্রাসার কয়েকজন আলেম ও লেখক বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

দলটি সংগঠিত উপায়ে এখনও কার্যক্রম না চালালেও এর একটি অংশ মুফতি হারুন ইজহারকে অনুসরণ করে। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে সক্রিয় হয়েছে ‘মানহাজি’। গত ২৭ অক্টোবর হাটহাজারীতে সংগঠনটির বিক্ষোভে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের আদলে পতাকার নকশায় বানানো ব্যানার ব্যবহৃত হয়। এরপর চট্টগ্রামের একটি সমাবেশে সেই একই ধরনের পতাকা দেখা গেছে।

আহমদ শফীর পরিবারের একজন সদস্য বলছেন, গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় আলেমদের ইসলাহি সভায় মুফতি হারুন ইজহার আল্লামা শফীকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করেন, ‘মাজুর’, ‘মতিভ্রম হয়েছে’। মাজুর (অক্ষম) শব্দটি আন্দোলনের লিফলেটে অনেকটা হুবহু এসেছে।

হাটহাজারীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১৪ সেপ্টেম্বর লালখান বাজার মাদ্রাসায় শপথ অনুষ্ঠান হয়েছে। এটা বাস্তব বলে শুনেছি। ওখান থেকে এসেই কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন করে।’

এসব অভিযোগ ও দাবি সম্পর্কে মুফতি হারুন ইজহারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এগুলো আজ প্রথম আপনার কাছে শুনলাম। এগুলো নিয়ে শেষ বক্তব্য ছিল ১২ সেপ্টেম্বর শনিবার কামরাঙ্গীরচরে। এরপর এ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আমরা আমাদের রুটি দাওয়াতি কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত।’

মুফতি হারুন ইজহার আরও বলেন, ‘হাটহাজারী ও আল্লামা শফী সাহেব সম্পর্কে কনসার্ন, যে কমিটমেন্ট, যে ভালোবাসা, তা কামরাঙ্গীরচরে সবকিছু বলেছি। লুকোচুরি করার কিছু নেই এখানে। হুজুর (আল্লামা শফী) আমাদের শিক্ষক, হুজুর আমাদের ইমাম, হুজুর পথভ্রষ্ট হতে পারেন না।’

কে এই রহস্যময় আমির?

“সন্ত্রাসীদের কাছে বের করার ফের আকুতি জানালে তারা বলে, আমাদের ‘আমিরের’ নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এখান থেকে বের করার কোনও অনুমতি নেই। আমরা আমিরের সঙ্গে কথা বলে দেখি।” কিছুক্ষণ পর আন্দোলনকারীরা বলে, ‘এইমাত্র আমিরের নির্দেশ এসেছে অ্যাম্বুলেন্সে করে হুজুরকে (আহমদ শফী) হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য।’ এভাবেই আহমদ শফীকে হাসপাতালে নিতে বিলম্ব হওয়ার বিষয়টি ‘হাটহাজারীতে জীবনের শেষ তিন দিন’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন তাঁর নাতি।

কে এই আমির? এমন প্রশ্নে বাংলা ট্রিবিউনকে কিছু জানাতে পারেননি আরশাদ। পরে হাটহাজারী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস, তাফসির ও হাদিস বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

স্থানীয় তরুণ একজন আলেম জানান, কথিত আমির হচ্ছেন গ্রন্থে উল্লেখ করা গত ১৬ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের প্রথম দিন আহমদ শফীর কক্ষে প্রবেশকারী দ্বিতীয় টিমের প্রধান নেতা শহিদুল্লাহ। যারা সেদিন মাগরিবের আগে আহমদ শফীর কক্ষে প্রবেশ করেছিল।

মাদ্রাসাটির একাধিক শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দাওরায়ে হাদিস শেষ করে শহিদুল্লাহ এখন তাফসির বিভাগের ছাত্র। তার বাড়ি হাটহাজারীতেই। স্থানীয় প্রভাবশালী একজন ব্যবসায়ীর সন্তান তিনি।

হাটহাজারীর সাবেক শিক্ষার্থী স্থানীয় একজন আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শহিদুল্লাহ এই আন্দোলনের মূল নেতা। সে কর্মসূচির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামনে আসেনি। নেপথ্যে থেকে নির্দেশনা দিয়েছে। এই আমির হচ্ছে শহিদুল্লাহ। আন্দোলনের সময় তাকে কেউ চেনেনি। তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল। পরে খোঁজ করতে করতে তার নাম সামনে এসেছে। যারা সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে, তারা কেউ বিক্ষোভের সামনে আসেনি। তারা কাজ করেছে ভেতরে, বুদ্ধি নিয়েছে বাইরে থেকে।’

যদিও শহিদুল্লাহ ‘আমির’ হওয়ার বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনের কাছে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এটা মিথ্যে, যারা অপবাদ দিচ্ছে, তারা কীসের ভিত্তিতে দিচ্ছে তার প্রমাণ নেই। আপনি আমাদের হুজুরদের সঙ্গে কথা বলুন।’

হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভাঙচুর, লুটপাট ও আহমদ শফীর চিকিৎসা বিলম্বের ঘটনায় তদন্ত নিয়ে বেফাকের কেউ কেউ আগ্রহী নয়

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে এমন তথ্য জানান।

তদন্ত কমিটি আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির বাকি দুইজন হলেন মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জি ও মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু।

তদন্ত এখনও শুরু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বেফাক। কিন্তু বেফাকে এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। যেহেতু সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার, তাই হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিবেশ না বুঝে তা করা যাবে না। আল্লামা শফীর মৃত্যু অস্বাভাবিক, আমি বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি করেছি।’

মুফতি ওয়াক্কাছের মন্তব্য, ‘আমি তার নাতির গ্রন্থটি পড়েছি। আন্দোলনের মূল যে শক্তি, সেটা বের করতে হবে। সেখানেও বলা হয়েছে, আমিরের নির্দেশ, কে এই আমির। কী হয়েছে আল্লামা শফীর মৃত্যুর আগে, আরও এক সপ্তাহ আগে কী হয়েছে, এগুলো বের করতে হবে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, এখন সরকার ঠিক করবে কী করবে।’

বেফাক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) ও আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ’র চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি যদি হয়েও থাকে, এ বিষয়টি আমার কাছে এখনও আসেনি। হাটহাজারী মাদ্রাসার বিষয়ে সেখান থেকে তো কেউ যোগাযোগ করেনি।’

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল (৩ ডিসেম্বর) ঢাকার একটি স্থানে শফীপন্থীদের একটি ইসলাহি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় চলমান কওমি মাদ্রাসার পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে শীর্ষ আলেমদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বেফাক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) মাওলানা মাহমুদুল হাসান। শনিবার এটি অনুষ্ঠিত হবে।

আহমদ শফীর মৃত্যু বিষয়ক মামলা আদালতে খারিজ, আবারও প্রক্রিয়া শুরু

মাওলানা আনাস মাদানীর ঘনিষ্ঠ মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হুজুরের ইন্তেকাল হয়েছে ঢাকায়, তাই আমরা ঢাকার সিএমএম কোর্টে মামলা করেছিলাম। কিন্তু কোর্ট থেকে বলা হয়েছে ঘটনাস্থল যেহেতু চট্টগ্রাম, তাই সেখানে করতে। আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছি।’

হেফাজতের শফীপন্থী প্রভাবশালী একজন আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আল্লামা শফীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সরকারের কাছে বিভিন্নভাবে বার্তা পৌঁছানো হয়েছে। তারা আবারও চেষ্টা করবেন মামলা করতে, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই ডিসেম্বরেই এ সংক্রান্ত উদ্যোগ প্রকাশ্যে আসবে। আহমদ শফীর পরিবারের পক্ষ থেকেই মামলা হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন মাওলানা আনাস মাদানীর ঘনিষ্ঠ এই আলেম।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি পত্রপত্রিকায় দেখেছি, তারাও দেখেছি টেলিভিশনে বলছেন, কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও কোনও লিখিত অভিযোগ আসেনি। কোনও অভিযোগ লিখিতভাবে এলেই আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলবো, বিষয়টি খোঁজ করতে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

সর্বশেষ খবর

Recent Comments